করোনা নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন ও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির (বিএমইউ) ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম।
মঙ্গলবার (২৪ জুন) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল অডিটোরিয়ামে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক জ্বরের প্রবণতা বিষয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন।
অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, করোনা নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। আর ডেঙ্গুর চিকিৎসা দিতে হবে ইভিডেন্স বেইসড মেডিসিনের ওপর ভিত্তি করে গাইডলাইন অনুসরণ করে। যদি গাইড লাইন অনুসারে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় তাহলে রোগী যেমন সঠিক বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা পাবেন আবার চিকিৎসা ব্যয়ও কমে আসবে। একই সঙ্গে রোগীর আরোগ্য লাভে ও জীবন বাঁচাতেও বিরাট ভূমিকা রাখবে।
প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) ও ইন্টারনাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ এর সভাপতিত্বে সেমিনারে আলোচনা করেন বিএমইউর প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. মুজিবুর রহমান হাওলাদার, সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবেদ হোসেন খান, সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বী চৌধুরী, সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল হাসান।
ডা. মো. নাজমুল হাসান জানান, ডেঙ্গু জ্বর এর হালকা উপসর্গে (যেমন: ৩-৫ দিন জ্বর, মাথাব্যথা, হালকা গায়ে ব্যথা) রোগীকে বাড়িতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও তরল পানীয় (স্যালাইন, ফলের রস, স্যুপ) গ্রহণ করতে হবে। জ্বর কমানোর জন্য কেবল প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যাবে (২৪ ঘন্টায় ৩ গ্রাম এর বেশি না)। অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন বা ব্যাথানাশক জাতীয় ওষুধ নিষিদ্ধ। কারণ এগুলো রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়ায়। জ্বর কমে যাওয়ার পর হঠাৎ শরীর খারাপ হওয়া, বারবার বমি, পেটব্যথা, রক্তপাত, ঘন ঘন দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট বা মলিন চামড়া, অস্থিরতা, অজ্ঞানভাব, মাথা ঘুরানো – এই উপসর্গ দেখা গেলে গর্ভবতী নারীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, স্টেরয়েড (যেমন ডেক্সামেথাসন, হাইড্রোকরটিসন) ব্যবহার রোগীর জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে, ফুসফুসে পানি জমার ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণায় প্রমাণিত, এতে ডেঙ্গুর চিকিৎসায় কোনো উপকার হয় না। অল্প কিছু ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শে স্টেরেয়ড ব্যবহার করা যাবে। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারেরও প্রয়োজন নেই, কারণ ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ। শুধুমাত্র যদি নিশ্চিত ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ থাকে (যেমন নিউমোনিয়া), তখন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করা যেতে পারে। অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার অকার্যকর ও বিপজ্জনক।
সম্প্রতি অনেকেই ডেঙ্গু রোগে প্লাটিলেট বাড়ানোর ঘরোয়া উপায় হিসেবে পেঁপে পাতার রস ও অন্যান্য ওষুধ ব্যবহার করছেন বলে উল্লেখ করেন ডা. মো. নাজমুল হাসান। তিনি বলেন, তবে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর মতে, পেঁপে পাতার রসে প্লাটিলেট বাড়ানোর বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়। এছাড়াও ভুল মাত্রায় গ্রহণ করলে বমি, পেটব্যথা ও লিভারের সমস্যাও হতে পারে। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় এটি কোনো বিকল্প নয়। বিশ্রাম, পর্যাপ্ত তরল খাবার গ্রহণ এবং সময়মতো হাসপাতালে যাওয়াই এখনো সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
তিনি জানান, প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন প্রয়োজন হয় তখনই যদি রোগীর প্লাটিলেট সংখ্যা খুব কমে যায় (১০,০০০-এর নিচে), রক্তপাত হচ্ছে অথবা অপারেশন বা ইনভেসিভ প্রসিডিউরের প্রয়োজন পড়ে। শুধু প্লাটিলেট কম থাকলেই রক্ত দেওয়া উচিত নয়। এতে অতিরিক্ত চাপ বা জটিলতা দেখা দিতে পারে। সম্পূর্ণ রক্ত বা রেড ব্লাড সেল ট্রান্সফিউশন শুধু তখনই বিবেচ্য, যখন রোগীর হিমোগ্লোবিন খুব কম বা রক্তপাতজনিত শক দেখা দেয়।
সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার ও ফিভার ক্লিনিক চালু করা প্রয়োজন বলে জানান এই চিকিৎসক। তিনি আরও বলেন, আইভি ফ্লুইড, রক্ত, রক্তের উপাদান ও জরুরি চিকিৎসার সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ ও ব্যবস্থাপনায়। ডেঙ্গু প্রতিরোধে জমে থাকা পানির পাত্র পরিষ্কার করা, ঘরের ভিতর ও বাইরের জলাধার ঢেকে রাখা, সপ্তাহে অন্তত একবার পানি ফেলে দেওয়া ও ব্লিচিং করা প্রয়োজন। কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা ও স্প্রে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। ডেঙ্গু একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। তবে ভুল চিকিৎসা ও গুজব ডেঙ্গুকে মারাত্মক করে তোলে। সরকারি নির্দেশনা মেনে চললে এবং নিজের আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখলে এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। ভুল তথ্য ও গুজব থেকে দূরে থাকুন, স্বীকৃত চিকিৎসা নিন।
সেমিনারে সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবেদ হোসেন খান জানান, চলমান বর্ষা মৌসুমে জুন-অক্টোবরে হঠাৎ করেই জ্বরজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার হাসপাতাল ও বহিঃবিভাগে। ভাইরাস জ্বর ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও কোভিড আক্রান্ত রোগীর ভিড় বাড়ছে। তাই রোগ নির্ণয়ে সচেতনতা ও দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবছর বর্ষা এলেই আমাদের ডেঙ্গু আতঙ্ক ফিরে আসে। এবছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আগে ঢাকায় ডেঙ্গু সংক্রমণ বেশি মনে করা হলেও এখন সারাদেশেই বিভিন্ন জেলায় এর সংখ্যা বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি সংক্রমন বর্তমানে বরিশাল ও বরগুনা জেলায়।
ডা. আবেদ বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও পরিবর্তিত জলবায়ুর ধারা ডেঙ্গু সংক্রমণের মূল কারণ। এই মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৮৭৭ জন। এবার ডিইএনওয়ান, ডিইএনটু এবং ডিইএনথ্রি সেরোটাইপ দিয়ে নতুনভাবে সংক্রমণ হচ্ছে। এ সপ্তাহে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এরইমধ্যে ঢাকা জেলায় ২ জন ও বরিশাল জেলায় ৫ জন মারা গেছেন বলে জানা যায়, বাচ্চাদের পাশাপাশি এখন বড়দেরও (বিশেষ ১৬-২৫ বছর) ডেঙ্গু আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি।
চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ নিয়ে তিনি বলেন, ২০১৭ সালের পর পুনরায় চিকুনগুনিয়ার প্রার্দুভাব বিগত বছরগুলোতে বেড়েছে। ১৯ অক্টোবর ২০২৪ থেকে ২২ এপ্রিল ২০২৫ এর মধ্যে ৫২০ জন সন্দেহভাজন রোগীর মধ্যে ১৬১ জনই চিকুনগুনিয়া ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত ছিলেন। চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যুঝুঁকি কম হলেও জ্বর পরবর্তী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (গিটে ব্যথা, র্যাশ, দুর্বলতা) রোগীদের জীবনমানে বিস্তর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এটি সাধরণ ভাইরাস জ্বর ভেবে উপেক্ষা করা উচিত নয়।
২০২০ সালে মহামারী আকার নিলেও করোনার সংক্রমণ ঝুঁকি এখনো শেষ হয়ে যায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি একটি পরিবর্তনশীল ভাইরাস যা পূর্বে আলফা, বিটা, ডেলটা অমিক্রন ইত্যাদি ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছিল। বর্তমানে অমিক্রনের সেরোটাইপ হিসেবে চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজে শনাক্ত করা হয়েছে। পূর্বের চেয়ে এবারের সেরোটাইপের সংক্রমণের হার অপেক্ষাকৃত বেশি। এমনকি আগেরবার করোনায় আক্রান্ত বা টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরও এর ঝুঁকি রয়েছে।
সাধারণভাবে শরীরে জ্বর থাকলে এবং জ্বরের সাথে কোনো রোগ বা অসুস্থতা থাকে, তখন তাকে ফেব্রাইল ইলনেস বলা হয়।
