প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে টাঙ্গাইলের নদ-নদীতে আয়োজন করা হয় ঐতিহ্যবাহী লোক-উৎসব ‘শাওনে ডালা’। বহু বছর ধরে এ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের চর্চা করে আসছেন স্থানীয় শিল্পীরা। যথারীতি এ বছরও অনুষ্ঠিত হলো এ উৎসব।
১৭ আগস্ট রোববার টাঙ্গাইলে ছিল শ্রাবণ সংক্রান্তির উৎসব ‘শাওনে ডালা’। বংশী নদ ও যমুনা নদীতে বেশ কয়েকটি দল এ উৎসবের আয়োজন করে। বছরের পর বছর সাপের বিষ নামানো ওঝারা এ সংস্কৃতি লালন করে আসছেন, যার পোশাকি নাম বেহুলার লাচারি। এ দিন সকালে লগ্ন ধরে এলেঙ্গা বাজার ঘাটে মনসার উদ্দেশে পুজা দেন ওঝারা। এরপর বন্দনাগীত গেয়ে নদীতে ভাসান নৌকা। সকালে মনির ওঝার দলকে বন্দনায় গাইতে শোনা যায় ‘এই তো আমার দেশ সোনার বাংলাদেশ’ গানটি। বন্দনা শেষে নৌকাভরে তারা যাত্রা করেন যমুনায়। এভাবে সাতঘাটে মনসার উদ্দেশে নৈবেদ্য ভাসান তারা। যাত্রাপথে চলতে থাকে গান।
এ বছর মনিরের নৌকা সেজেছিল ভিন্ন সাজে। পাঁচমাথার এক বিরাট সাপ যেন অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলো তার নৌকায়। শেষ ঘাটে বেহুলা-লখিন্দরের পালা করার জন্য নাটকের পোশাকে প্রস্তুত ছিল বেহুলা, লখিন্দর, ত্রিশুল হাতে শিব, বাঘসহ বেশ কয়েকটি চরিত্র। মনিরের দলের পুরুষ সদস্যরাই মেয়ে সেজে অভিনয় করেন এতে। মনির জানান, বহু বছর ধরে তারা এ পুজার আয়োজন করে আসছেন। তাদের বিশ্বাস পুজা করলে সাপের দেবতা তুষ্ট থাকে, সারা বছর উৎপাত করে না, কাউকে কামড়ালেও বিষ নামানোর জন্য বিনামূল্যে ওষুধ দেন তিনি।
এ উৎসবের জন্য শ্রাবণ মাসের শুরুতে পুজার ঘট স্থাপন করা হয়, তারপর বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে অর্থ ও পুজার উপকরণ সংগ্রহ করেন ওঝারা। শ্রাবণ মাসের শেষে করেন পুজার আয়োজন। এ বছর প্রথমবারের মতো তারা পেয়েছেন ইউনেস্কোর সহযোগিতা। এ ছাড়া কালিহাতীর মশাজান গ্রামে ঘট স্থাপন ও শাওনের ডালা নিয়ে গবেষণার জন্য গ্রামীণ সাংস্কৃতিক গবেষণা কেন্দ্র তৈরি করে দিয়েছে সাংস্কৃতিক সংস্থা সাধনা।
শাওনে ডালার এ বছরের উৎসব অনুসরণ করতে ঢাকা থেকে যোগ দেন একদল শিল্পী, গবেষক ও সংস্কৃতির শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ছিলেন সাংস্কৃতিক সংস্থা ব্রতীর মহাপরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম, ব্যবস্থাপক মাইকেল মনীষ সাহা, নৃত্যগুরু সাজু আহমেদ, নৃত্যভঙ্গি গবেষক ফেরদৌস আহমেদ, সাধনার শাওনে ডালা উন্নয়ন প্রকল্পের ইনচার্য লাবণ্য সুলতানা, লেখক গাজী মুনছুর আজিজ, রাসেল মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয় ও শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। ভূঞাপুরের নলিন বাজার উত্তর ঘাট থেকে যমুনা নদীতে বেশ কয়েকটি দলকে দেখা যায় ভিন্ন ভিন্ন নৌকায়।
সেসব নৌকায় যোগ দিয়েছিলেন স্থানীয় বহু মানুষ। সাতঘাটে থেমে নৈবেদ্য ভাসিয়ে তারা এগিয়ে যান।
শাওনে ডালায় নৌকা ভাসায় গণেশবাবু নাট্য সংঘ, মনিকা অপেরা, শাখারিয়া বেহুলা লাচারি শিল্পীগোষ্ঠী, লালমিয়া শিল্পীগোষ্ঠী, একডালা যাত্রাপালা, ভাইবোন যাত্রাপালা। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় নৌকাটির পিছু নেয় ঢাকা থেকে যোগ দেওয়া আগ্রহী দলটি। ভোরের আলো নামে বিশাল ট্রলারটিতে পরিবেশন করছিল গণেশবাবু নাট্য সংঘ। উপচে পড়া মানুষ বেহুলা-লখিন্দরের নাটক উপভোগ করছিলেন চলন্ত নৌযানে। ট্রলারের ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে মাইকে শোনা যাচ্ছিল নাটকের সংলাপ। অন্য নৌকা থেকেও সেসব দেখছিলেন নৌপথে যাত্রীরা। সন্ধ্যায় তারাকান্দির একটি ঘাটে গিয়ে শেষ হয় দলটির কার্যক্রম। সেখানেই সাপেকাটা লখিন্দরকে ভাসিয়ে দেওয়া হয় যমুনায়। বেহুলার চরিত্রে অভিনয় করেন বারেক এবং লখিন্দরের ভূমিকায় মিজানুর।
‘শাওনে ডালা’ বাংলাদেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। নদীমাতৃক দেশে সাপের উৎপাত থেকে রক্ষা পেতে বহুকাল ধরে পুজা দেওয়া হতো সাপের দেবী মনসাকে। সনাতন সংস্কার হলেও মুসলমান ওঝারা এখনও সেটি ধরে রেখেছেন। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মনসামঙ্গল কাব্যের নাট্যাংশ।
